Landscape view not supported, please use protrait view!
বঙ্গবন্ধু বায়োপিক : মুম্বাইতে যেভাবে চলছে শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে ছবির শুটিং

বঙ্গবন্ধু বায়োপিক : মুম্বাইতে যেভাবে চলছে শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে ছবির শুটিং

ভারতে বিনোদনের রাজধানী মুম্বাইয়ে শহরতলির এক প্রান্তে পাহাড়, লেক আর গাছগাছালিতে ঘেরা দাদাসাহেব ফালকে চিত্রনগরী বা ফিল্মি সিটি - সেখানেই দিনপনেরো আগে শুরু হয়েছে বহুপ্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু বায়োপিকের শুটিং।

অ্যারে পার্ক নামে একটা বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়ি অরণ্যের কোলে বিছোনো এই ফিল্ম সিটি, আপাতত তারই অন্তত ছটা লোকেশনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর সেট।

কোথাও টুঙ্গিপাড়ার নদীর ঘাট বা ফুটবল মাঠ, কোথাও আবার শেখ মুজিবের স্মৃতিবিজড়িত কলকাতার বেকার হোস্টেল।

আসলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার মিলে তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই।

বঙ্গবন্ধু নামে এই ছবিটির সম্ভাব্য পরিচালক হিসেবে তিনজনের নামও প্রস্তাব করে ভারত, যার মধ্যে থেকে বলিউডের বর্ষীয়ান নির্মাতা শ্যাম বেনেগালকেই বেছে নেয় বাংলাদেশ।

কিন্তু এরপর কোভিড মহামারি ও আরো নানা কারণে সেই ছবির শুটিং বারে বারে বিলম্বিত হয়েছে। অবশেষে এ বছরের গত ২১ জানুয়ারি মুম্বাইতে মহরতের মাধ্যমে শুরু হয়েছে ছবির প্রথম পর্বের কাজ।

পরিচালক ভারতীয় হলেও ছবির প্রায় নব্বই শতাংশ অভিনেতাই অবশ্য বাংলাদেশের। আর তা ছাড়াও এটি প্রথমত একটি বাংলা ছবি, যা পরে ইংরেজি ও হিন্দিতে ডাব করা হবে।

ফিল্মের প্রযোজক দুটো দেশের সরকার - অথবা বলা যেতে পারে তাদের চলচ্চিত্র শাখা বিএফডিসি ও এনএফডিসি।

ফলে অর্থটা যে এখানে কোনও সমস্যা নয়, সেটে বিশাল আয়োজন আর কয়েকশো মানুষকে নিয়ে কর্মযজ্ঞ দেখলেই সেটা দিব্বি বোঝা যায়!

শ্যাম বেনেগালের কথা

অসম্ভব উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে এই পুরো কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছিয়াশি বছরের তরুণ শ্যাম বেনেগাল।

ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই মুম্বাইতে কাঠফাটা রোদ আর তার সঙ্গে শরীর নিংড়ে নেওয়া আর্দ্রতা - এর মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে তিনি রোজ শুট করছেন টানা বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে।

কল-টাইম কখনও ভোর পাঁচটা, কখনও বেলা বারোটা। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে বেনেগাল স্যার কিন্তু রোজ সেটে হাজির - সঙ্গে তাঁর পুরো টিম।

"সেই প্রায় চল্লিশ বছর আগে আরোহণ নামে একটা বাংলা ছবি করেছিলাম, তারপর এটা আমার দ্বিতীয় বাংলা ছবি। যদিও দুটোর মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না", হাসতে হাসতে বিবিসিকে বলছিলেন প্রবীণ পরিচালক।

"আসলে এর আগেও গান্ধী, সুভাষ বোস, নেহরুর জীবন নিয়ে কাজকর্ম করেছি, এই জঁনর-টাই আমার খুব প্রিয়।"

"এবার বাঙালি জাতীয়তাবাদের নায়ককে নিয়ে কাজ করার এত বড় সুযোগ - সেই ড্রাইভটাই বোধহয় আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছে", পেঁপের টুকরো মুখে ফেলে স্মিত হেসে বলছিলেন শ্যাম বেনেগাল।

সেই সঙ্গেই তিনি জানালেন, মুম্বাইতে এখন ফিল্মের যে কাজগুলো হচ্ছে সেগুলো মূলত শেখ মুজিবের জীবনের প্রথম পর্ব ও পারিবারিক অংশটুকুর - পরিচালকের কথায় যেটা ছবির ডোমেস্টিক পার্ট।

"এটা একটা খুব লম্বা কাজ, লং হল! এপ্রিলে ভারতের এই অংশটুকুর কাজ শেষ হয়ে যাবে। এরপর মনসুন শেষ হলে, ধরা যাক আগস্টের শেষ দিকে বা সেপ্টেম্বরের গোড়ায় লোকেশন সরে যাবে বাংলাদেশের বিশাল ক্যানভাসে।"

"যেমন ধরুন শেখ মুজিবের বিশাল জনসভাগুলো। উনি তো আর দশটা মানুষের সামনে ভাষণ দিতেন না, তাঁর কথা শুনতে হয়তো পাঁচ লক্ষ মানুষের ভিড় হতো।"

"তো সেই জিনিস তো আর এখানে রিপ্রোডিউস করা সম্ভব নয়, বাংলাদেশেই ওটা করতে হবে", বলছিলেন শ্যাম বেনেগাল।

শেখ হাসিনা ও চিত্রনাট্যের রাজনীতি

বঙ্গবন্ধু বায়োপিকের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন শ্যাম বেনেগালের বহুদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী শামা জাইদি, সঙ্গে ছিলেন অতুল তিওয়ারি।

প্রবাদপ্রতিম পরিচালক এম এস সথ্যুর স্ত্রী শামা নিজেও থিয়েটার ও চলচ্চিত্র দুনিয়ার একজন কিংবদন্তী, এর আগেও শ্যাম বেনেগালের বহু ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি।

এই বিরাশি বছর বয়সেও তিনি প্রায় রোজই বঙ্গবন্ধুর সেটে আসছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাচ্ছেন।

শামা জাইদি বলছিলেন, শুধু জাতির নায়ক হিসেবে নন, এই ছবিতে তারা শেখ মুজিবকে ধরতে চেয়েছেন তাঁর একান্ত পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকেও।

"এ কারণেই আমরা যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি, প্রথমেই তাঁকে বলেছিলাম আমরা ছবিটা বানাতে চাই আপনার মায়ের চোখ দিয়ে, শেখ মুজিবের প্রিয় রেণুর চোখ দিয়ে।"

"এরপর টানা দুদিন ধরে শেখ হাসিনা আমাদের তাঁর মায়ের গল্প শুনিয়েছিলেন।"

"একজন নিরীহ গ্রামের মেয়ে, যে তাঁর স্বামীকে রাজনীতিতে আসতে দিতে চায় না - সেখান থেকে ফজলেতুন্নিসা মুজিব কীভাবে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর সার্থক অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন সেটাই তিনি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন", বলছিলেন শামা জাইদি।

তিনি আরও জানাচ্ছেন, এই চিত্রনাট্যের রাজনীতির দিকটাও শুধরে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।

"শেখ হাসিনা আমাদের বলেছিলেন, নান্দনিক দিক থেকে আপনারা চিত্রনাট্যে যা খুশি করুন আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু চিত্রনাট্যে যে রাজনীতির অংশটা, সেটা কিন্তু নিজেই দেখে দিয়েছেন।"

"বস্তুত রোজ ফজরের নামাজের পর শেখ হাসিনা নিজেই স্ক্রিপ্টটা নিয়ে ঘন্টাদুয়েক বসতেন। তারপর নোট নিয়ে আমাদের নানা মূল্যবান পরামর্শ দিতেন, যেগুলো চিত্রনাট্যে প্রতিফলিত হয়েছে", বিবিসিকে জানালেন শামা জাইদি।

মুজিব কোট ও কলারের কারসাজি
শেখ মুজিবের নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট, পোশাক-আশাক আর বিখ্যাত মুজিব কোট নিয়েও অনেক গবেষণা করেছে টিম বঙ্গবন্ধু।

এই মুভিতে কস্টিউম ডিজাইন করছেন পিয়া বেনেগাল, যার ঝুলিতে রয়েছে বলিউডের বহু ছবির জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা।

ফিল্ম সিটির এক প্রান্তে তার নেতৃত্বে চলছে বঙ্গবন্ধুর শিল্পীদের শত শত পোশাক তৈরির কারখানা। অবিরাম সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় আর কাঁচির কারিকুরিতে তৈরি হচ্ছে পিরিওড ফিল্মের কস্টিউম।

স্মার্ট অ্যান্ড ড্যাশিং হ্যান্ডসাম শেখ মুজিবের পরিণত বয়সের ড্রেস সেন্স মুগ্ধ করে রেখেছে পিয়া বেনেগালকেও।

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "যদি ওঁনার মুজিব কোটের কথাই ধরি, তার যেমন চমৎকার কাট - তেমনি একটা দারুণ আইডিয়া হল সেই কোটের হোয়াইট ইনার কলার, যেটা রোজ পাল্টানো হত।"

"আমি ঠিক জানি না এই কলারের আইডিয়াটা মুজিবের নিজস্ব, না কি তাঁর গৃহিণীর - কিন্তু এই ঘাম আর ধুলোর দেশে এই আলাদা কলারের ভাবনাটা চমৎকার একটা কনসেপ্ট।"

"একটা কোটের জন্য আসলে অনেকগুলো কলার থাকত - আর কোট তো আর রোজ কাচাকুচি করা সম্ভব নয়, কিন্তু নোংরা হলেই সাদা কলারটা পাল্টে নেওয়া খুব সোজা", কোটের আলাদা কলারের উচ্ছ্বসিত তারিফ করে বলছিলেন পিয়া।

এভাবেই এই ফিল্মের শ্যুটিংয়ে ছোটখাটো নানা খুঁটিনাটির মধ্যে দিয়ে চলছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন করে আবিষ্কারের পালা।

আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে যে এই বায়োপিকের শ্যুটিং শুরু হল সেটাকেও নিছক সমাপতন ভাবার কোনও কারণ নেই।

বস্তুত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কালচারাল ডিপ্লোম্যাসি বা সাংস্কৃতিক কূটনীতিরই একটা মাইলফলক হয়ে থাকছে এই ফিল্ম বঙ্গবন্ধু।

শুভজ্যোতি ঘোষ
বিবিসি বাংলা, দিল্লি